বেশ কয়েক বছর আগে ভাষা আন্দোলন ও ভাষার সূত্রে বাঙালি জাতীয়তাবোধের বিবর্তন নিয়ে ইংরেজিতে একটা লেখা দাঁড় করাতে গিয়ে একদম গোড়ার অ-আ-ক-খ প্রশ্নগুলি নিয়েই বেশ হাবুডুবু খেয়েছিলাম। জাতি কি, জাতীয়তাবাদ কি, জাতীয় পরিচয় (‘ন্যাশনাল আইডেন্টিটি’) কি এসবই যদি ঠিকমত না জানি, তাহলে জাতীয়তাবোধের বিবর্তন নিয়ে লিখি কিভাবে। এই প্রশ্নগুলি নিয়ে তখন থেকেই মনের মধ্যে কৌতুহল নাড়াচাড়া করছিল। সেইসাথে লিখতে গিয়ে আরও প্রশ্ন জেগেছিল - রাষ্ট্র, জাতি, জাতীয়তা, জাতীয় পরিচয়, জাতীয় স্বার্থ, দেশপ্রেম, জাতি বা সমষ্টির বেশে সমষ্টির নির্বাচিত বা স্বনির্বাচিত প্রতিনিধিত্বপরায়নদের এই ধরণের সামগ্রিক-সামষ্টিক গোষ্ঠীগত বিষয়গুলিতে কর্তৃত্বশীলতা, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঐ গোষ্ঠীভুক্ত বিভিন্ন ধরণের এলিট শ্রেণী বা মাইক্রো-গোষ্ঠী দ্বারা আর্টিকুলেটেড ও নির্ধারিত বা আরোপিত হয়ে থাকে - তার সাথে ব্যক্তি তার ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রেক্ষিত থেকে কিভাবে ও কতটুকু নিজেকে খাপ খাওয়াতে ও সম্পর্কিত করতে পারে, কিম্বা পারে না। না পারলে - পুরো বা আংশিক, সেই না পারাটার নৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার ও অনধিকার, বৈধতা বা অবৈধতা কতটুকু, এবং সেটা কিভাবে নির্ধারিত হবে বা হওয়া উচিত। এর সাথে ছিল আমাদের ’৫২-র ভাষা আন্দোলন আর তার অগ্র ও পশ্চাৎ সূত্র ধরে বাংলাদেশে আমাদের ‘জাতীয় পরিচয়’ সংক্রান্ত চিন্তাভাবনার বিবর্তন ও পার্সেপশন সম্পর্কে আগ্রহ। রাজনীতির ময়দানে মুসলমান না বাঙালি, পাকিস্তানি না বাঙালি এবং পরে ‘বাঙালি না বাংলাদেশি’ – এইসব নিয়ে কম মাথা ফাটাফাটি তো হয়নি। তো এগুলি বুঝতে হলে আগে জাতি, জাতীয়তা, জাতীয় পরিচয় – এইসব মৌলিক টার্মগুলি তো আগে পরিষ্কার হতে হবে। তার উপরে বাংলায় এই শব্দগুলি নিয়ে বেশ ধোঁয়াশা রয়েছে মনে হয়, যা বেশ বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। ইংরেজি যে ‘নেশন’ শব্দের বঙ্গানুবাদ হিসেবে বাংলায় ‘জাতি’ শব্দটা ব্যবহার করা হয়, যদ্দুর বুঝেছি ইংরেজিতে এবং পাশ্চাত্যের কনটেক্সটে তার বেশ সুনির্দিষ্ট একটা অর্থ রয়েছে যা বিশেষ একটা ফেনোমেননকে বোঝায়। অথচ বাংলায় আমরা ‘জাতি’ বলতে অনেক কিছুই বুঝি – ‘নেশনও’ বুঝি, আবার এথনিক/নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী, ভাষিক গোষ্ঠী, থেকে শুরু করে ধর্ম, বর্ণ – ত্বকবর্ণ ও হিন্দু ধর্মীয় বর্ণপ্রথার বর্ণ, শ্রেণী, বংশ, পেশা, লিঙ্গ, প্রাণীর প্রজাতি হয়ে এমনকি ফুলফল বা প্রায় যে কোন সমলক্ষণযুক্ত শ্রেণীবিন্যাসকেই বুঝি। এর ফলে বাংলায় এই আলোচনা অনেক সময় একটি অর্থে শুরু হয়ে অনেক সময় নিজেদের অগোচরেই কাছাকাছি অন্য অর্থে পিছলে বা সুইচ করে অর্থের তালগোল পাকিয়ে ফেলে এবং তখন একটা থেকে আরেকটা কেন, কখন ও কতটুকু পৃথক সেই জট ছোটানো অনেক সময় বেশ কঠিন হয়ে পড়ে – এমনকি হয়তো সেটা নজরেই আসে না। আলোচনা তখন দিশা হারিয়ে ফেলে।
ব্যুৎপত্তিগত অর্থে জাতি বলতে বুঝায় এক বংশোদ্ভূত জনসমষ্টি।তবে বর্তমানে জাতি আর ব্যুৎপত্তিগত অর্থ ব্যবহৃত না হয়ে এক বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত হয়।আধুনিককালে জাতি বলতে সেই জনসমষ্টিকে বোঝায় যারা কতকগুলো সাধারণ ঐক্যবোধে আবদ্ধ ও সংগঠিত।ম্যাকাইভারের মতে,"জাতি হচ্ছে ঐতিহাসিক পরিস্থিতি দ্বারা সৃষ্ট,আধ্যাত্নিক চেতনা দ্বারা সমর্থিত এবং একত্রে বসবাস করার সংকল্প সংবলিত সম্প্রদায়গত মনোভাব,যারা নিজেদের জন্য সাধারণ সংবিধান রচনা করতে আগ্রহী।"